অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কেন?
### অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কেন?
গণরোষের মুখে সোমবার ক্ষমতা ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়া আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তার পদত্যাগের ফলে মন্ত্রিসভাও ভেঙে গেছে।
মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিয়েছেন, ফলে দেশ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সরকার কাঠামোও এখন নেই। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, হত্যাসহ নানা ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে।
এ কারণে সংসদ ভেঙে দিয়ে দ্রুত অন্তর্বর্তীকালীন একটি সরকার গঠনের তাগিদ দিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। মঙ্গলবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “রাষ্ট্রপতির কাছে আহ্বান জানাচ্ছি, কাল বিলম্ব না করে আজকের মধ্যেই পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করুন।”
“অন্যথায় দেশে আবার রাজনৈতিক শূন্যতা দেখা দিতে পারে,” বলেন মি. আলমগীর।
এদিকে, শেখ হাসিনার পতনের পর গঠিত হতে যাওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কে হবেন তা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। এরই মধ্যে মঙ্গলবার ভোরে ফেসবুকে প্রকাশিত এক ভিডিও বার্তায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।
ভিডিও বার্তায় নাহিদ ইসলাম বলেন, “আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে সর্বজনগ্রহণযোগ্য এবং আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে।”
তিনি দ্রুত এই সরকার গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতির প্রতি আহ্বান জানান। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হওয়ার বিষয়ে ইতোমধ্যেই তারা অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে কথা বলেছেন বলেও জানান।
“ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গেও আমাদের কথা হয়েছে। তিনি ছাত্র-জনতার আহ্বানে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে এই গুরু দায়িত্ব নিতে সম্মত হয়েছেন,” বলেন নাহিদ ইসলাম।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই নেতা এটাও স্পষ্ট করেছেন যে, তারা ছাত্র-নাগরিকদের সমর্থিত সরকার ছাড়া সামরিক কিংবা অন্য কোনো ধরনের সরকারকে সমর্থন দেবেন না।
“আমরা রক্ত দিয়েছি, শহীদ হয়েছি। আমাদের প্রতিশ্রুতি একটি নতুন বাংলাদেশ গঠন করার জন্য। সেটিকে অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে এবং ছাত্র-জনতার প্রস্তাবিত সরকার বাদে অন্য কোনো ধরনের সরকার মেনে নেওয়া হবে না,” বলেন তিনি।
সংবিধানে কী আছে?
বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ নামে কোনো ব্যবস্থার উল্লেখ নেই।
তবে কাছাকাছি ধরনের একটি ব্যবস্থার কথা আগে বলা ছিল, যেটি ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ নামে পরিচিত। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান ও ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে এই পদ্ধতি অনুসরণ করেই তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
কিন্তু ২০১১ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান সংশোধন করে এই ব্যবস্থা বাতিল করে। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ক্ষমতায় থাকা সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এরপর ওই সরকারই বিজয়ী রাজনৈতিক দল বা জোটের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।
কিন্তু নির্বাচন ছাড়াই হুট করে সরকারের পতন ঘটায় বর্তমানে দেশে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটি বিবেচনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের দাবি উঠেছে।
“অথচ এ ব্যাপারে সংবিধানে কিছুই বলা নেই,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক। মূলত সে কারণেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ঘিরে আইনগত এক ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।
কোন উপায় আছে?
সংবিধানকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভিত্তি বলা হয়ে থাকে। ফলে এটি না থাকলে দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে নানা সমস্যা ও সংকট তৈরি হবে।
এখন সংবিধানে উল্লেখ না থাকলেও প্রয়োজনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে কি? কোন উপায় কি আছে?
সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক বলেন, "উপায় অবশ্যই আছে, তবে সেটি করতে হলে বর্তমান সংসদ বহাল রেখেই সরকার গঠনের চেষ্টা করতে হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন আইনজীবী মি. মালিক।
এক্ষেত্রে বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে যতজনকে পাওয়া যায়, তাদেরকে নিয়েই নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করতে হবে।
“সংবিধান রক্ষার স্বার্থে এটি নামমাত্র মন্ত্রিসভা হবে। তাদেরকে দিক নির্দেশনা দেওয়ার জন্য উপদেষ্টামণ্ডলী রাখা হবে এবং তারাই রাষ্ট্র পরিচালনার মূল দায়িত্ব পালন করবেন,” বলেন মি. মালিক।
তবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ইতোমধ্যেই সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। যদিও সংবিধান অনুযায়ী সে এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির আছে কি না, সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
“বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, এককভাবে সংসদ বিলুপ্ত করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির নেই,” বলেন আইনজীবী শাহদীন মালিক।
তিনি আরও বলেন, “সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রীর লিখিত পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সংসদের অধিবেশন আহ্বান, সমাপ্তি এবং সংসদ বিলুপ্তি করবেন।”
সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদের প্রথম ধারায় বলা হয়েছে, “সরকারী বিজ্ঞপ্তি দ্বারা রাষ্ট্রপতি সংসদ আহ্বান, স্থগিত ও ভঙ্গ করবেন, তবে তার দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক লিখিতভাবে প্রদত্ত পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন।”
তবে নির্বাহী আদেশে ইতোমধ্যেই সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে এখন কী করা যাবে?
“পোস্ট ভ্যালিডিটি প্রয়োগ করে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ গঠন করা যেতে পারে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল।
উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশেষ ক্ষমতাবলে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার পর সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে পরবর্তীতে সেটির বৈধতা দেওয়াকে আইনের ভাষায় 'পোস্ট ভ্যালিডিটি' বা দায়মুক্তি বলা হয়ে থাকে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর গৃহীত সামরিক শাসনের সব কর্মকাণ্ডকে ১৯৭৯ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। একইভাবে, ১৯৮৮ সালে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। যদিও সামরিক শাসনের বৈধতা দেওয়া পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীকে ২০১০ সালে উচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষণা করে।
১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদের পতনের পর পঞ্চম সংসদের নির্বাচন পরিচালনার জন্য তিন মাসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছিল। সে সময় আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিসহ আন্দোলনকারী সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। বিচারপতি আহমদকে প্রথমে উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।
নির্বাচনের পরে তিনি প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে যান। এই বিষয়গুলোর বৈধতা দেওয়া হয়েছিল সংবিধানের একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে, যা ১৯৯১ সালে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত পঞ্চম সংসদে পাস করা হয়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন